হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ ও পুরাণে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)।

প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ ভবিষ্য পুরাণে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে 'মহামদ' নামে এক মহাপুরুষ মরুভূমিতে আপন দলবল-সহ আবির্ভূত হবেন এবং তিনি জগতের যাবতীয় কলুষনাশ করবেন ।

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ ও পুরাণে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)।

এতস্মিন্নন্তরে ম্লেচ্ছ আচার্যেন সমন্বিতঃ। মহামদ ইতি খ্যাতঃ শিষ্যশাখা সমন্বিতঃ(৫)। নৃপশ্চৈব মহাদেবং মরুস্থল নিবাসিনম্। গঙ্গা জলৈশ্চ সংস্নাপ্য পঞ্চগব্য সমম্বিতৈঃ চন্দনা দিভিরভর্চ তুষ্টাব মনসা হরম্(৬)।

 নমস্তে গিরিজানাথ মরুস্থল নিবাসিনে। ত্রিপুরাসুর নাশায় বহুমায়া প্রবর্তিণে(৭)। লিঙ্গচ্ছেদো শিখাহীন শ্মশ্রুধারী সদুষকঃ। উচ্চালাপী সবর্ভক্ষী ভবিষ্যতি জননাময়(২৬)। (ভবিষ্যপুরাণ, প্রতিসর্গ পর্ব, ৩য় খণ্ড, ৩য় অধ্যায়, শ্লোক নং ৫, ৬, ৭, ২৬)

সরলার্থ :একজন ম্লেচ্ছ আচার্য (বিদেশে অবস্থিত এবং বিদেশি ভাষায় বাক্যালাপকারী) শিষ্যদের নিয়ে আবির্ভূত হবেন। তার নাম হবে মহম্মদ এবং তিনি মরুস্থলনিবাসী। 

গঙ্গাজলের দ্বারা (বহমান পানিতে অজু করে) পঞ্চগব্য-সহ (নামাজ দ্বারা) মনের আনন্দ লাভ করবেন। হে মরুস্থলের প্রভু, তোমার প্রতি আমার স্তুতিবাদ। তুমি জগতের সমুদয় কলুষ নাশ করার বহু উপায় জানো, তোমাকে নমস্কার। 

হে পবিত্র পুরুষ। আমাকে তোমার চরণতলে স্থান দাও। তার লিঙ্গের অগ্রভাগ ছেদিত, তিনি টিকিবিহীন এবং তিনি দাড়ি রাখবেন। উচ্চস্বরে ধ্বনি করবেন (আযান দেবেন) এবং সকলকে আশ্রয়দান করবেন।

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ - এ মহম্মদ (সাঃ)।

অথর্ববেদের ‘কুন্তাপ সূক্তে' বিশ্বনবি মহম্মদ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্বাভাস স্পষ্ট ইঙ্গিতে উচ্চারিত হয়েছে অথর্ববেদের ২০শ কাণ্ডের একত্রিংশ (৩১) সূক্তকে কুন্তাপ সূক্ত বলা হয়। ‘কুন্তাপ’ শব্দটি বিবিধ অর্থে ব্যবহৃত এবং প্রতিটি অর্থই গভীরভাবে ব্যঞ্জনাময়।

'কুন্তাপ’ শব্দটির অর্থ ‘দুঃখ ও কষ্ট ধ্বংসকারী’ পৃথিবীর সমস্ত দুঃখের প্রতিকারের উদ্দেশ্যে এই সুক্ত গীত হয়। ইসলামের আদর্শ এবং মহম্মদ (সাঃ)-এর আলোকিত শিক্ষাই পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ মোচনের একমাত্র উপায়। তার শিক্ষা মানবতার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

'কুন্তাপে'র অর্থ ‘শান্তির বার্তাবাহক। কুন্তাপের অপর অর্থ ‘শান্তির বার্তাবাহক'। মহম্মদ (সাঃ) তো পৃথিবীর বুকে শান্তির বার্তাবাহক। তাঁকে সমগ্র বিশ্বের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছিল।

'কুন্তাপ’ শব্দের অন্য একটি অর্থ ‘উদরে লুকানো গ্রন্থি ‘কুন্তাপ’ শব্দের অন্যতম অর্থ হল ‘উদরে লুকানো গ্রন্থি'। পণ্ডিতরা মনে করেন :

“পৃথিবীর নাভিপ্রদেশ অথবা মাঝখানে অবস্থিত 'মক্কা' নগরী হল কুন্তাপ। আবার 'মক্কা’ শব্দের অন্য অর্থ ‘উদর'। কোরআনে ‘মক্কা’কে ‘বাক্কা’-ও বলা হয়েছে, যার অর্থ ‘বৃক্ষ'। 'কুন্তাপ’ শব্দটি 'মক্কা’ ও ‘বাক্কা’—এই উভয় অর্থেই প্রযোজ্য। একজন মানুষ মায়ের উদর এবং বক্ষ—এই দুটি স্থানেই লালিত হয়। 

তাই কুন্তাপের মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে মানবজাতিকে লালন করার দুগ্ধ মক্কাভূমিতেই আছে। যে তার মাকে চিনতে পারবে, সে-ই তার কাছে যাবে।”[Mohammad in World Scriptures (Adam Publishers, Delhi) pages 68–69]

কুন্তাপ সূক্তের প্রথম মন্ত্র (খিলানি)।

ইদং জনা উপশ্রুত নরাশংস স্তবিষ্যতে। ষষ্টিং সহস্রা নবতিং চ কৌরম আ রুশমেষু দদ্মহে(১)। (অথর্ববেদ : ২০শ কাণ্ড, ৯ম অনুবাক, ৩১ সূক্ত, শ্লোক ১)

'নরাশংস স্তবিষ্যতে’-এর অর্থ ‘মানবকুলে তিনি হবেন প্রশংসনীয়'। ‘মহম্মদ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থই হল ‘প্রশংসনীয়'। অর্থাৎ, এই শব্দগুচ্ছের মধ্য দিয়ে মানবকুলের সবচেয়ে প্রশংসনীয় মানুষটি যে ধরার বুকে আবির্ভূত হতে চলেছেন তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

'কৌরম’ শব্দের দুটি অর্থ : যিনি শান্তি বিস্তার করেন, যিনি দেশত্যাগ করেন। ‘কৌরম’ শব্দের দুটি অর্থই মহম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে প্রযোজ্য। নিখিল জগতের প্রতিপালক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে শান্তির বার্তাবাহক হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। 

এই শান্তির বার্তাবাহক মক্কার অবিশ্বাসীদের অত্যাচারে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন মাতৃভূমি ত্যাগ করে মদিনায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। একে ‘হিজরত’ বলে।

'রুশমেষু’ শব্দের অর্থ নবি (সাঃ)-এর শত্রু। উপরের এই মন্ত্রের অনুবাদ করতে গিয়ে পণ্ডিত রাজারাম লিখেছেন : “তোমরা শোনো! তিনি হলেন সমস্ত মানুষের মধ্যে প্রশংসনীয়। 

ষাট হাজার নব্বই জনের মধ্যে আমরা সেই ‘কৌরম’কে বরণ করে নেব।” ঐতিহাসিকদের মতে, তখন মক্কার জনসংখ্যা ছিল ষাট থেকে সত্তর হাজারের মতো।

কুন্তাপ সূক্তের দ্বিতীয় মন্ত্র।

উস্ট্রা যস্য প্রবাহণো বধুমন্তো দ্বির্দশ। বরস্মা রথস্য নি জিহীড়তে দিব ঈষমাণা উপস্পৃশঃ(২) এই উষ্ট্র-আরোহী ঋষি দ্বাদশ পত্নীধারী হবেন, যিনি রথে আরোহণ করে স্বর্গে ভ্রমণ করবেন।

এই স্বর্গ ভ্রমণ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রফিকউল্লাহ লিখেছেন – “স্বর্গ ভ্রমণ ইসলামের ইতিহাসে ‘মিরাজ’ বা মেরাজ নামে সুপরিচিত। 'মিরাজ' শব্দের অর্থ উর্ধ্বগমন বা স্বর্গভ্রমণ। ৬২১ খ্রিস্টাব্দের রজব মাসের ২৭ তারিনে তাঁর এই মিরাজ বা স্বর্গ ভ্রমণ অনুষ্ঠিত হয়। 

গভীর রাতে যখন তিনি কাবাগৃহের চত্বরে ঘুমোচ্ছিলেন, তখন জিবরাইল (আঃ) তার ঘুম ভাঙালেন। হজরত দেখলেন, অদূরে ক্ষিপ্রগতি ডানাবিশিষ্ট অশ্বের আকৃতি জ্যোতির্ময় স্বর্গীয় বাহন 'বোরাক’ অপেক্ষা করছে। 

স্বর্গীয় দূত জিবরাইল (আঃ)-এর সহায়তায় তিনি ওই স্বর্গীয় অশ্ব বোরাকে আরোহণ করে প্রথম মক্কার মসজিদুল-হারাম (কাবাশরিফ) থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস বা জেরুজালেমের মসজিদে গমন করলেন।.... 

তারপর একে একে সাত আসমান অতিক্রম করলেন। ...... তারপর বেহেস্ত, দোজখ পরিদর্শন করে তিনি তাঁর পরম স্রষ্টা ও পরমবন্ধু জ্যোতির্ময় আল্লাহতায়ালার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন।” (ইসলামের ইতিহাস ; পৃ. ৩৮-৩৯)

কুন্তাপ সূক্তের তৃতীয় মন্ত্র।

এষ ইষায় মামহে শতং নিষ্কান দশ স্রজঃ। ত্ৰীণি শতান্যবর্তং সহস্রা দশ গনাম(৩)। ‘মামহে’ শব্দের অর্থ মহম্মদ (সাঃ)। 'শতং নিষ্কান’-এর অর্থ একশো স্বর্ণমুদ্রা। এখানে ‘স্বর্ণমুদ্রা’ বলতে সংসারত্যাগী, আল্লাহ-বিশ্বাসী একদল সাহাবিকে বোঝানো হয়েছে, যারা ইতিহাসে ‘আসহাবে সুফফা’ নামে খ্যাত।

দশ স্বজঃ’-এর অর্থ দশটি জপমালা। এখানে বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন বিখ্যাত সাহাবির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা ইতিহাসে ‘আশারা মোবাশ্বারা’ হিসেবে খ্যাত।

‘ত্রীণি শতান্যবর্তাং’-এর অর্থ তিনশো অশ্ব। বদর যুদ্ধে (৬২৪ খ্রিঃ) অংশগ্রহণকারী সাহাবাদের বোঝানো হয়েছে। তাঁদের প্রকৃত সংখ্যা ছিল তিনশো তেরো।

সহস্রা দশ গোনম-এর অর্থ দশ হাজার গোরু। অষ্টম হিজরিতে মহম্মদ (সাঃ)-এর যে দশ হাজার সাহাবি ছিল, এখানে তাদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। বেদ-এ গোরু পবিত্রতার প্রতীক। অন্য অর্থে, গোরু বিজয়ের স্মারক। 

এই শ্লোকের অনুবাদ করতে গিয়ে পণ্ডিত রাজারাম লিখেছেন – “তিনি মামহ ঋষিকে দিলেন একশো স্বর্ণমুদ্রা, দশটি জপমালা, তিনশো ঘোড়া এবং দশ সহস্র গোরু।”

কুন্তাপ সূক্তের চতুর্থ মন্ত্র।

বচ্যস্ব রেভ বচ্যস্ব বৃক্ষে ন পক্বে শকুনঃ। নষ্টে জিহ্বা চৰ্চরীতি ক্ষুরো ন ভুরিজোরিব(৪)। মর্মার্থ : তিনি এবং তাঁর অনুগামীরা সর্বদা প্রার্থনার প্রতি মনোযোগী। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও তারা প্রভুর উদ্দেশে মাথা নত করেন।” এখানে মুসলমানদের দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে।

কুন্তাপ সূক্তের পঞ্চম মন্ত্র।

প্র রেভাসো মনীষা বৃষা গাব ইবেরতে। অমোত পুত্ৰকা এষাম মোত গা ইবাসতে(৫)। এর অনুবাদ করতে গিয়ে পণ্ডিত রাজারাম লিখেছেন – “তিনি জগৎকে দিয়েছিলেন জ্ঞানের আলো, অর্থাৎ পবিত্র কোরআন।” (Mohammad in World Scriptures Adam Publishers, Delhi) Page 104)।

এই সমস্ত মন্ত্র থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে মহম্মদ (সাঃ)-এর আগমন সম্পর্কে হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল তার জন্মের অনেক আগেই। অজ্ঞতাবশত অনেকে তা বোঝেননি, অথবা বুঝলেও নীরব থেকে গিয়েছেন। 

তিনিই যে আর্তমানবতার পথের দিশারি, তিনিই যে এপার-ওপার দুপারের পথপ্রদর্শক তা যে ব্যক্তি উপলব্ধি করবেন, তিনি ইহকাল ও পরকালে সফলকাম হবেন।

ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের সাদৃশ্য - সূচিপত্র।