হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের গ্রন্থ সমূহ।

ইসলাম ধর্মে গ্রন্থ সমূহ।

নিখিল জগতের প্রতিপালক আল্লাহ প্রতিটি যুগেই গ্রন্থ পাঠিয়েছেন। সূরা রা'দ’-এ আছে— “তোমার পূর্বেও অনেক রসূল প্রেরণ করেছিলাম প্রত্যেক নির্ধারিত কালের জন্য এক গ্রন্থ থাকে।” (১৩ নং সূরা , আয়াত ৩৮) কোরআনে চারটি ঐশী গ্রন্থের কথা উল্লিখিত হয়েছে। 

(এক) তৌরাত—মুসা (আঃ)-এর কাছে অবতীর্ণ হয়েছিল। (দুই) জবুর—দাউদ (ডেভিড) আঃ-এর কাছে অবতীর্ণ হয়েছিল। (তিন) ইঞ্জিল-ঈশা (যেসাস) আঃ-এর কাছে অবতীর্ণ হয়েছিল। (চার) কোরআন-হজরত মহম্মদ (সাঃ)-এর কাছে অবতীর্ণ হয়েছিল।

কোরআন মহান আল্লাহর শেষ গ্রন্থ এবং মহম্মদ (সাঃ) তার শেষ প্রেরিত পুরুষ। পূর্ববর্তী সমস্ত গ্রন্থ সমূহ নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অবতীর্ণ হয়েছিল। সমস্ত গ্রন্থ শেষ মহিমান্বিত গ্রন্থ আল-কোরআনের জন্য অপেক্ষারত ছিল। কোরআনের মধ্যেই আল্লাহ তার গ্রন্থ সম্পূর্ণ বলেন। 

পূর্বের অপূর্ণতা পূর্ণতায় রূপান্তরিত হল, খণ্ডতা পেল অখণ্ড অবয়ব। নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী ও নির্দিষ্ট সময়ের বেড়াজাল অতিক্রম করে আল-কোরআন হয়ে উঠল বিশ্বজনীন, সর্বকালীন। কোরআন শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য অবতীর্ণ হয়নি, কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য। 

হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের গ্রন্থ সমূহ।

কোরআনে মানুষের স্বভাব ধর্মের কথা উল্লিখিত হয়েছে, নির্দেশিত হয়েছে মহাসাফল্যের আলোকিত ঠিকানা। 

পার্থিব কোনও যন্ত্রের প্রস্তুতকারক যেমন যন্ত্রটির সঙ্গে ‘manual' (সারগ্রন্থ) প্রেরণ করেন, তেমনি মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ মানুষকে সঠিক পথে চলার জন্য সারগ্রস্ত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন আল-কোরআন, যা মানুষকে বলে দিয়েছে ইহকাল ও পরকালে সফলকাম হওয়ার পদ্ধতি। 

কোরআনি গ্রন্থের আলোক-ইশারা বজায় থাকবে মহাধ্বংস বা কেয়ামত পর্যন্ত। সব নদী এসে যেমন সাগরে মেশে তেমনি পর সমস্ত গ্রন্থ স্রোতধারা আল-কোরআনের মহাসাগরে এসে একাকা হয়ে গেছে। 

কোরআনকে না মানলে পূর্ববর্তী গ্রন্থধারীদের ধর্ম যে সম্পূর্ণ হবে না একথা বলাই বাহুল্য। অনন্ত করুণাময়, পরম দয়ালু আল্লাহ সূরা ইব্রাহিমে’ ঘোষণা করেছেন আলিফ-লাম-রা, এ ঐশী গ্রন্থ, এ তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি মানবজাতিকে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে, অন্ধকার থেকে আলোকে বের করে আনতে পারো, 

তার পথে, যিনি পরাক্রমশালী, প্রশংসাহ। (১৪ নং সূরা , আয়াত ১) ওই ‘সুরা ইব্রাহিমের’ শেষ আয়াতে তিনি আবারও বলেছেন – “এ মানুষের জন্য এক বার্তা, যাতে এ দ্বারা ওরা সতর্ক হয় এবং জানতে পারে যে তিনি একমাত্র উপাস্য এবং যাতে বোধশক্তিসম্পন্নরা উপদেশ গ্রহণ করে। 

(১৪ নং সূরা , আয়াত ৫২) ‘সূরা বাকারাহ’য় মহান আল্লাহ জানিয়েছেন : “রমযান মাস, এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।” (২ নং সূরা , আয়াত ১৮৫) 

বিশ্বনিখিলের এক ও অদ্বিতীয় প্রতিপালক সর্বশক্তিমান পরম দয়ালু আল্লাহ। ‘সূরা যুমার’-এ আবারও একইভাবে ঘোষণা করেছেন – “আমি তোমার প্রতি মানুষের জন্য সত্যসহ গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি, অতঃপর যে সৎপথ অবলম্বন করে সে তা নিজেরই কল্যাণের জন্য করে এবং যে বিপথগামী হয় সে তো বিপথগামী হয় নিজেরই ধ্বংসের জন্য এবং তুমি ওদের তত্ত্বাবধায়ক নও।” 

(৩৯ নং সুরা , আয়াত ৪১) আল-কোরআন আল্লাহর শেষ প্রত্যাদেশ এবং এই প্রত্যাদেশ যে আসছে সে কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছিল পূর্ববর্তী প্রত্যাদেশগুলিতে। “সূরা শোয়া'রায় “পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে অবশ্যই এর উল্লেখ আছে।” (২৬ নং সুরা , আয়াত ১৯৬)

ইসলাম ধর্মের হাদিস গ্রন্থ।

ইসলামের আরও একটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হল হাদিস। হাদিস মহম্মদ (সাঃ)-এর বাণী। মহিমান্বিত আসমানি গ্রন্থ কোরআন মাজিদের পরিপূরক হল হাদিস। 

কোরআনে যা বলা হয়েছে তারই বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে হাদিসে। বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহর ইঙ্গিতে তাঁরই প্রিয়তম প্রেরিত পুরুষ মহম্মদ (সাঃ) উচ্চারণ করেছিলেন হাদিসের আলোকিত বাণী।

হিন্দু ধর্মের পবিত্র গ্রন্থসমূহ।

হিন্দুধর্মের দুই শ্রেণির গ্রন্থ আছে; যথা—শ্রুতি ও স্মৃতি। শ্রুতি : ‘শ্রুতি’ শব্দের অর্থ—যা শ্রবণ করা যায় এবং যা উপলব্ধি করা যায়। শ্রুতি হিন্দুদের সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ। শ্রুতিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়; যথা -- ১. বেদ, ২. উপনিষদ। এই দুটি গ্রন্থকে ঐশীগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

স্মৃতি : ‘স্মৃতি’ শব্দের অর্থ—যা মনে রাখা হয়। শ্রুতির মত স্মৃতি অত প্রাচীন গ্রন্থ নয়। ‘স্মৃতি’কে ঐশীগ্রন্থ হিসেবেও বিবেচনা করা হয় না। তবুও আজ হিন্দুদের মধ্যে ‘স্মৃতি’ সবচেয়ে জনপ্রিয়। 

'স্মৃতি' মানুষের লেখা। স্মৃতির মধ্যে হিন্দুর জীবনবিধান ও ধর্মাচরণের পদ্ধতি লিপিবদ্ধ আছে। স্মৃতি তাই ধর্মশাস্ত্র রূপে পরিচিত। স্মৃতিকে আবার দুভাগে ভাগ করা হয়; যথা- ক. পুরাণ ও খ. মহাকাব্য।

বেদ।

‘বেদ’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘বিদ’ ধাতু থেকে, যার অর্থ জানা। তাই ‘বেদ’ শব্দটির অর্থ ‘সর্বোত্তম জ্ঞান’। বেদকে চারভাগে ভাগ করা হয়; যথা- ঋক্, সাম, যজুঃ, অথর্ব। 

পতঞ্জলির মহাবৈশ্যের মতে, ঋগ্বেদের ২১টি শাখা আছে, অথর্ববেদের ৯টি শাখা আছে, যজুর্বেদের ১০১টি শাখা আছে, সামবেদের ১০০০টি শাখা আছে। অর্থাৎ বেদের সর্ব মট শাখা ১১৩১টি। এর মধ্যে মাত্র এক ডজন সহজলভ্য।

ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ এবং সামবেদ অধিকতর প্রাচীন গ্রন্থ। এদের ‘বিদ্যাত্রয়ী’ বা ‘বিজ্ঞানত্রয়ী’ বলা হয়। এদের মধ্যে ঋগ্বেদ প্রাচীনতম। ঋগ্বেদ লিপিবদ্ধ করা হয় তিনটি দীর্ঘকালের ব্যবধানে। 

চতুর্থ বেদ হল অথর্ববেদ যা অপেক্ষাকৃত নবীন। ঋগ্বেদে আছে স্তুতি গান। যজুর্বেদে আছে আত্মত্যাগের নিয়মনীতি। সামবেদ সঙ্গীতমুখর। অথর্ববেদে আছে রোগ নিরাময়ের ম্যাজিক ফরমুলা।

চারটি বেদ কখন লেখা হয়েছে সে-ব্যাপারে সর্বসম্মত কোনও মত নেই। আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ স্বামীর মতে, বেদ লেখা হয়েছিল কোটি কোটি বছর আগে। তার এই মত যে অতিরঞ্জিত সেকথা বলাই বাহুল্য। পণ্ডিতদের মতে, চার হাজার বছরের আগে বেদ লিপিবদ্ধ হয়নি।

মতভেদ আছে বেদের আবির্ভাব স্থান সম্পর্কেও। বেদের প্রত্যাদেশ কোনও ঋষিদের উপর আরপিত হয়েছিল কিনা তা-ও জানা যায়নি। তবে এতটুকু বলা যায়, বেদ হিন্দুদের সবচেয়ে প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থ। প্রকৃত হিন্দুত্ব বেদ ছাড়া ভাবা যায় না।

উপনিষদ।

‘উপনিষদ’ শব্দটি বিভাজন করলে পাওয়া যায় ‘উপ-নি-ষদ। উপ-এর অর্থ ‘কাছে। নি’-র অর্থ ‘নিচে’, ‘ষদ’-এর অর্থ ‘বসা। একসঙ্গে করলে ‘উপনিষদের অর্থ দাঁড়ায় ‘নিচে কাছে বসা। প্রাচীনকালে শিষ্যরা গুরুদেবের পায়ের কাছে বসে যে পবিত্র ধর্মজ্ঞান লাভ করতেন তা-ই উপনিষদ। শংকরাচার্যের মতে, ‘উপনিষদে’র মূলে আছে ‘ষৎ' ধাতু।

তার আগে ‘উপ’ ও ‘নি’ এই দুটি উপসর্গ যুক্ত হয়েছে। 'ষৎ'-এর অর্থ ‘মচন করা’ ‘পৌছানো’ অথবা ‘ধ্বংস করা'। আর ‘উপনিষদ’-র পূর্ণাঙ্গ অর্থ হল ‘ব্রহ্মজ্ঞান যার দ্বারা অজ্ঞতা ধ্বংস হয়।উপনিষদের সংখ্যা সম্ভবত ২০০টিরও বেশি, যদিও ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী এর সংখ্যা ১০৮। অবশ্য মূল উপনিষদের সংখ্যা ১০, কেউ কেউ বলেন ১৮।

'বেদান্ত’ কথাটির অর্থ বেদের অন্ত বা উপনিষদ। যদিও বর্তমানে এই শব্দটি দ্বারা উপনিষদভিত্তিক দর্শন ও প্রথাকে বোঝানো হয়। বেদের উপসংহারে উপনিষদ এসেছে—তাই বেদের অন্তিমলগ্ন ও উপনিষদের আবির্ভাবলগ্ন একই।

কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে বেদের চেয়েও উপনিষদ শ্রেষ্ঠতর।

মহাকাব্য।

ভারতবর্ষের প্রাচীন মহাকাব্য দুটি— রামায়ণ ও মহাভারত।

রামায়ণে আছে, রামচন্দ্রের কাহিনী। অধিকাংশ হিন্দু-ই এই কাহিনী সম্পর্কে অবগত।

অন্য মহাকাব্যের নাম মহাভারত, যাতে আছে কৌরব ও পাণ্ডবের মধ্যকার সামন্ততান্ত্রিক জ্ঞাতি লড়াই। এতে কৃষ্ণের কাহিনীও সংযোজিত হয়েছে। মহাভারতের গল্প সাধারণভাবে সমস্ত হিন্দুই জানেন।

ভাগবদগীতা।

ভাগবদ্গীতা হিন্দুদের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে পরিচিত ধর্মগ্রন্থ। এটি মহাভারত মহাকাব্যের অংশ। এতে ১৮টি অধ্যায় আছে। গীতা মূলত কৃষ্ণের উপদেশ যা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রদত্ত হয়েছিল অর্জুনের উদ্দেশে।

পুরাণ।

পুরাণও হিন্দুদের বহু পঠিত ধর্মগ্রন্থ। 'পুরাণ’ কথাটির অর্থ ‘প্রাচীন'। পুরাণে আছে সৃষ্টির ইতিহাস, আর্যদের ইতিহাস, বিভিন্ন স্বর্গীয় আত্মার গল্প। বেদের ঠিক পরেই পুরাণের আবির্ভাব। মহর্ষি বৈশ্য পুরাণকে ১৮টি খণ্ডে বিভক্ত করেছিলেন। পুরাণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ভবিষ্যপুরাণ।

ভবিষ্যপুরাণের এই রকম নামকরণের কারণ হল এতে আছে ভবিষ্যতের নানান ঘটনাপ্রবাহের আগাম ইঙ্গিত বা ভবিষ্যদ্বাণী। হিন্দুরা মনে করেন ভবিষ্যপুরাণ স্বয়ং ঈশ্বরের বাণী, মহর্ষি বৈশ্য একে শুধু বিভিন্ন পর্বে বিভাজিত করেছিলেন।

অন্যান্য গ্রন্থ।

হিন্দুদের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মনুস্মৃতি।

হিন্দুদের সবচেয়ে প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থ বেদ।

কালের ব্যবধানে হিন্দুসমাজে অনেক ধর্মগ্রন্থের আবির্ভাব ঘটলেও সবচেয়ে প্রামাণিক হিন্দু ধর্মগ্রন্থ হল বেদ। হিন্দু পণ্ডিতদের মতে, যদি অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ও বেদের মধ্যে অসঙ্গতি দেখা যায়, তবে বেদকেই বিশ্বাসযোগ্য ভাবতে হবে।

তাই আমরা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি।

ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের সাদৃশ্য - সূচিপত্র।