জিহাদ সম্পর্কে ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম কি বলে।

জিহাদ সম্পর্কে মুসলিম এবং অ-মুসলিম উভয়েরই মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে। তারা মনে করেন, ভালো এবং মন্দ যে কোনও উদ্দেশ্যে মুসলমানরা যে লড়াই করেন, সেটাই জিহাদ। ‘জিহাদ’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘জাহাদা’ থেকে, যার অর্থ চেষ্টা করা’ বা ‘লড়াই করা।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি একটি ছাত্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা করে, ধরে নিতে হবে সে-ও জিহাদ করছে। তবে ইসলামি পরিভাষায় ‘জিহাদ’ শব্দের অর্থ নিজের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই। 

এর অন্য একটি অর্থ, সমাজের উন্নতি সাধনে সচেষ্ট হওয়া। আত্মরক্ষার জন্য লড়াই এবং আগ্রাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই-ও জিহাদ।

জিহাদ সম্পর্কে ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম কি বলে।

জিহাদ ধর্মযুদ্ধ নয়।

শুধুমাত্র অমুসলিম পণ্ডিতরাই নন, মুসলিম পণ্ডিতরাও ‘জিহাদ’ শব্দের অনুবাদ করতে গিয়ে ধর্মযুদ্ধ’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। আরবিতে ‘ধর্মযুদ্ধ’কে বলা হয় হারাবাম্ মুকাদ্দাস'। 

এই কথাটি কোরআন এবং হাদিসের কোথাও কিন্তু উল্লিখিত হয়নি। খ্রিস্টানদের ‘ক্রসেড’ বর্ণনা করতে গিয়ে ধর্মযুদ্ধ কথাটি প্রথম ব্যবহৃত হয়।

খ্রিস্টানরা ধর্মের নামে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল আর নিজেদের অপরাধ ঢাকার জন্য সেই হত্যাকাণ্ডের নাম দিয়েছিল ‘হোলি ওয়ার’ বা ধর্মযুদ্ধ। তাই ‘জিহাদ’ আর ধর্মযুদ্ধ এক নয়। 

জিহাদ’ মানে আল্লাহর দেওয়া জীবন, আল্লাহর দেওয়া অর্থ এবং আল্লাহর দেওয়া সময়কে আল্লাহর পথে কাজে লাগানো।

জিহাদের অনেক রূপের মধ্যে একটি রূপ হল লড়াই।

আগেই বলেছি, ‘জিহাদ’ কথাটির অর্থ চেষ্টা করা’ বা ‘লড়াই করা। এ লড়াই অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই। ইসলামের কট্টর সমালোচকরা ‘সূরা তওবা’র ৫ নং আয়াত মাঝে-মধ্যেই উদ্ধৃত করেন। 

সেখানে আছে— “অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে অংশীবাদীদের যেখানে পাবে তাদের বন্দি করবে, অবরোধ করবে, (৯ নং সূরা , আয়াত ৫) যদি আপনি কোরআন পড়েন তাহলে দেখবেন এই আয়াতটি আনুপূর্বিক প্রসঙ্গ ছাড়াই উদ্ধৃত হয়েছে।

‘সুরা তওবা'র প্রথম আয়াতে অংশীবাদীদের সঙ্গে মুসলিমদের শান্তিচুক্তির কথা আছে। ৪র্থ আয়াতে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সেই চুক্তি পালনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। 

কিন্তু অংশীবাদীরা একতরফাভাবে সেই চুক্তিভঙ্গ করেছিল। এরই প্রেক্ষিতে চারমাস অতিবাহিত হওয়ার পর যুদ্ধের ঘোষণা করা হয়েছিল।

এই পঞ্চম আয়াতে মুসলমানদের লড়াই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শত্রুর বিরুদ্ধে। যেমন একজন সেনাধ্যক্ষ সৈন্যদের মনোবল বাড়ানোর জন্য ঘোষণা করেন, ‘ভয় পেয়ো না, লড়াই করো, শত্রুকে নিধন করো”। 

সূরা তওবার পঞ্চম আয়াতেও তেমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইসলামের সমালোচকরা আগে-পিছে না তাকিয়ে ছিদ্রান্বেষীর মতো ইসলামের খুঁত ধরার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শুধু ওই আয়াতটিই উদ্ধৃত করেন।

অথচ তার ঠিক পরের আয়াতেই আছে - ‘আর অংশীবাদীদের মধ্যে কেউ তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তুমি তাকে আশ্রয় দেবে, যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়, অতঃপর তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেবে, কারণ তারা অজ্ঞ লোক।” (৯ নং সুরা , আয়াত ৬) 

সমগ্র বিশ্বের কোনও দেশে, কোনও কালে কোনও সেন্যাধ্যক্ষ কি কখনও শত্রুদের সম্পর্কে এমন নির্দেশ দিয়েছেন? 

চুক্তিভঙ্গকারী আশ্রয় প্রার্থনাকার শত্রুকে আশ্রয়দান করার পর নিরাপদ স্থানে পৌছে দেওয়ার আদেশ আর কোনও ধর্মগ্রন্থে আছে কি? ইসলামের সমালোচকরা এসব দেখেও দেখেন না-কারণ এদের উদ্দেশ্য তো সমালোচনা করা।

ভাগবদ্গীতায় জিহাদ।

সমস্ত ধর্মের অনুগামীদের ‘চেষ্টা করতে' অথবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভাগবদ্গীতায় আছে : “হে অর্জুন! যোগ অভ্যাস করো। যা সমস্ত কর্মের কৌশল স্বরূপ।” (২য় অধ্যায় , শ্লোক ৫০)।

ভাগবদ্গীতায় লড়াই বা যুদ্ধের নির্দেশ।

সমস্ত বড় ধর্মে অন্যায় এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মহাভারত একটি মহাকাব্য। হিন্দুদের কাছে এটি খুবই পবিত্র। এতে আছে কৌরব ও পাণ্ডব নামক দুই জ্ঞাতি ভ্রাতৃগোষ্ঠীর মধ্যে লড়াইয়ের কাহিনী। যুদ্ধক্ষেত্রে পাণ্ডবদের মুল যোদ্ধা অর্জুন আত্মীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অনীহা প্রকাশ করেন। হত্যাকাণ্ডে তার বিবেক ভারাক্রান্ত হয়।

এই সময় কৃষ্ণ তাকে উপদেশ দেন এবং উদ্বুদ্ধ করেন। কৃষ্ণের সেই উপদেশমালা নিয়ে তৈরি হয় ভাগবদ্গীতা। গীতার বিভিন্ন শ্লোকে কৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। আত্মীয়ও যদি শত্রু হয়, তাকেও হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

১. ভাগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায়ের ৪৩-৪৬ শ্লোকে বলা হয়েছে। 

৪৩) ও কৃষ্ণ, মানুষের পরিচালক, আমি শুনেছি যারা আত্মীয় পরিজনদের ধ্বংস করে তারা নরকে বাস করে।

৪৩) ‘হায়! অবাক লাগে যে রাজসুখ ভোগ করার জন্য আমরা নিজেরাই মহাপাপের কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

৪৫) যুদ্ধ করার পরিবর্তে আমি বরং ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হাতে নিরস্ত্র অবস্থায় মারা যেতে চাই।'

৪৬) এ সমস্ত কথা বলে, তির-ধনুক পাশে ফেলে দিয়ে অর্জুন রথের উপর বসে পড়লেন। তার মন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।

২. উত্তরে কৃষ্ণ বললেন (ভাগবদ্গীতা : ২ নং অধ্যায় : শ্লোক ২, ৩)

২) প্রিয় অর্জুন, এমন মালিন্য তোমার মধ্যে এল কীভাবে? এই মনোভাব সেই মানুষের মানায় না যিনি জানেন জীবনের প্রগতিশীল মূল্যবোধ। এই মালিন্য কাউকে স্বর্গের দিকে নিয়ে যায় না, বরং অখ্যাতির দিকে নিয়ে যায়।

৩) হে বৎস পার্থ, মর্যাদাহানিকর দুর্বলতার কাছে আত্মসমর্পণ করো না। এটা তোমার মানায় না। হে অরিন্দম, হৃদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতা ত্যাগ করে জেগে ওঠো।

৩. কৃষ্ণ আরও বললেন (ভাগবদগীতা : ২ নং অধ্যায়, শ্লোক ৩১-৩৩) :

৩১) “ক্ষত্রিয়ের কর্ম বিবেচনা করো। তোমার জানা উচিত ধর্মীয় নীতির ভিত্তিতে যুদ্ধ করা ছাড়া তোমার জন্য অধিকতর শুভকর্ম আর নেই। সুতরাং তোমার দ্বিধা করার প্রয়োজন নেই।

৩২) হে পার্থ! সেই ক্ষত্রিয়রাই সুখী যাদের কাছে না চাইতেই এমন যুদ্ধের সুযোগ চলে আসে যা কেবলমাত্র স্বর্গের দ্বারকেই উন্মুক্ত করে।

৩৩) “যদি তুমি এই ধর্মীয় যুদ্ধ না করো, তবে নিশ্চয়ই তুমি পাপে জড়িয়ে পড়বে কর্তব্যে অবহেলা করার কারণে এবং এই ভাবে যোদ্ধা হিসেবেও তুমি তোমার খ্যাতি হারাবে।'

৪. ভাগবদ্গীতায় শতাধিক এমন শ্লোক আছে যেখানে যুদ্ধ ও হত্যায় উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। যার সঙ্গে কোরআনের পূর্বোক্ত আয়াতের অদ্ভুতভাবে কিছুটা মিল আছে।

ধরুন আনুপূর্বিক প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে কেউ যদি বলেন যে ‘ভাগবদ্গীতায় পারিবারিক সদস্যদের হত্যা করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে, তাহলে তিনি নারকীয় কাজ করবেন। 

কিন্তু আমি যদি বলি সত্য এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অশুভশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা অবশ্যকর্তব্য, তাহলে তার একটি প্রাসঙ্গিকতা থাকবে।

৫. আমার অবাক লাগে কোরআনে যখন অশুভশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা থাকে বা অশুভ শত্রুকে বিনাশ করার কথা থাকে তখন ইসলামের কট্টর সমালোচকরা সে দিকে আঙুল তোলেন কীভাবে। আমার মনে হয় তারা ভাগবদ্গীতা, মহাভারত বা বেদের মতো পবিত্র গ্রন্থগুলি পাঠ করেননি।

৬. হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের সমালোচকরা কোরআন এবং নবি (সাঃ)-এর সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, জিহাদে যারা নিহত হন তাদের জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। 

কোরআন থেকে উদ্ধৃতি তোলার সঙ্গে সঙ্গে তারা বুখারি শরিফের ‘জিহাদ’ অধ্যায়ের (২ নং অধ্যায়) ৪৬ নং হাদিস উদ্ধৃত করেন- ‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে মুজাহিদকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যদি সে নিহত হয়, অন্যথায় সে বাড়ি ফিরে আসবে যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী-সহ।

ভাগবদ্গীতাতে অনেক শ্লোক আছে যেখানে বলা হয়েছে যে কোনও ব্যক্তি পবিত্র যুদ্ধে মারা গেলে স্বর্গে প্রবেশ করবে। ভাগবদ্গীতার ২নং অধ্যায়ের ৩৭ নং শ্লোকে আছে - ‘হে কুন্তীর পুত্র! 

যদি তুমি যুদ্ধে নিহত হও তাহলে তুমি স্বর্গে প্রবেশ করবে অথবা যদি তুমি জয়ী হও তাহলে তুমি পার্থিব রাজত্ব ভোগ করবে। তাই ওঠো এবং দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে যুদ্ধ করো।

৭. অনুরূপভাবে ঋগ্বেদেও শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই এবং শত্রু বিনাশের কথা উল্লিখিত হয়েছে। ঋগ্বেদ সংহিতার ১ মণ্ডলের ১৩২ সূক্তের ২ নং থেকে ৬নং শ্লোকে যুদ্ধ ও শত্রু নিধনের কথা বারে বারে ঘোষিত হয়েছে। 

এই অংশের শেষ শ্লোকে আছে “হে ইন্দ্র ও পর্জন্য! তোমরা দুজনে অগ্রগামী হয়ে যে শত্রু আমাদের বিরুদ্ধে সেনা সংগ্রহ করে তাদের সকলকেই বিনাশ করো। বজ্র প্রহার দ্বারা তাদের সকলকেই বিনাশ করো।” (ঋগ্বেদ-সংহিতা, ১ মণ্ডল, ১৩২ সূক্ত, শ্লোক ৬; অনুবাদ : রমেশচন্দ্র দত্ত ; পৃ. ১৮৩)

জিহাদ ব্যাখ্যা করতে হবে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি-সহ।

বিশ্বজগতের প্রতিপালক পরম স্রষ্টা আল্লাহ কোরআন শরিফে ঘোষণা করেছেন : “তমি বলো, হে ধর্মগ্রন্থধারীগণ! এসো সে কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই।” (সুরা আল-ই-ইমরান : ৩ নং সুরা , আয়াত ৬৪)।

ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মনে যে ভুল ধারণা আছে তা ব্যাখ্যা করার সবচেয়ে উপায় হল অন্যান্য ধর্মের পবিত্র গ্রন্থগুলিতে অনুরূপ যে সমস্ত বাণী আছে সেগুলি উদ্ধৃত করা। 

যে হিন্দুরা ইসলামধর্মে জিহাদের ব্যাপারটা সমালোচনা করেন তাদের মহাভারত ও ভাগবদ্গীতা থেকে অনুরূপ শ্লোক উদ্ধৃত করে দেখান। 

উদ্ধিতি চয়ন করার সময় যখন আনুপূর্বিক প্রসঙ্গ উল্লেখ করি তখন তারা একমত হন যে কোরআনে যদি সত্যের সঙ্গে মিথ্যার এবং অশুভশক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির লড়াইয়ের কথা থাকে তাহলে কোরআনের পথ নির্দেশিকাই তাদের কোন আপত্তি নেই, বরং তারা তাকে মর্যাদা দান করেন।

 ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের সাদৃশ্য - সূচিপত্র।