হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর ও আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা। হিন্দু ধর্মে মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ।

উপনিষদে ঈশ্বর, আল্লাহ ও মূর্তি পূজা সম্পর্কে। 

ছান্দোগ্য উপনিষদে (৬/২) আছে -- " একমেবদ্বিতীয়ম্‌ " তিনি এক, অদ্বৈত।

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৬/৮) আছে-- " ন তস্য কারযং করণঞ্চ বিদ্যতে ন তৎসমশ্চাব্যধিকশ্চ দৃশ্যতে ।" সরলার্থ--- পরমেশ্বরের শরীর নেই, ইন্দ্রিয়ও নেই,তাঁর সমান বা তাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ কেউ নেই।

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের (৬/৯) শ্লোকে আছে-- " ন চাস্য কশ্চিৎ জনিতা ন চাধিপঃ।" সরলার্থ--- তাঁর কোনও জনক বা অধিপতি নেই।

হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর ও আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা। হিন্দু ধর্মে মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ।

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের (৪/১৯) শ্লোকে আছে-- " ন তস্য প্রতিমা অস্থি।" সরলার্থ ----- সেই পরমেশ্বর অখণ্ড এবং অদ্বিতীয়, এজন্য তাঁর প্রতিমা বা প্রতিকৃতি নেই।

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের (৪/২০) শ্লোকে আছে-- " ন সন্দৃশে তিষ্ঠতি রূপমস্য ন চক্ষুষা পশ্যতি কশ্চনৈনম্‌ ।" সরলার্থ--- এই পরমেশ্বরের স্বরূপ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, কেউই তাঁকে চক্ষু দ্বারা দর্শন করতে পারে না। ( এই সমস্ত শ্লোকের বাংলা উচ্চারণ ও সরলার্থ গ্রহণ করা হয়েছে অতুলচন্দ্র সেন অনূদিত "উপনিষদ" থেকে।)

ভাগবদ্গীতায় ঈশ্বর, আল্লাহ ও মূর্তি পুজা সম্পর্কে। 

ভাগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায়ের ২০ নং শ্লোকে আছে---- "যারা বস্তগত আকাঙ্ক্ষার দ্বারা বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে তারা দেবতাসমূহের পূজা করে; সত্যিকার ঈশ্বরের পরিবর্তে বিভিন্ন দেবতাই বস্তবাদীদের আরাধ্য।"(৭-২০)

ভাগবদ্গীতার দশম অধ্যায়ের ৩ নং শ্লোকে আছে---- "যে আমাকে জন্মরহিত, সূত্রপাতরহিত এবং সমগ্র জগতের একমাত্র অধিশ্বর হিসেবে জানে ( সে-ই সফলকাম )।" (১০-৩)

হিন্দুদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্মগ্রন্থ হল ভাগবদ্গীতা আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে মূর্তিপূজাকে সমর্থন করা হয়নি।

বেদ ঈশ্বর, আল্লাহ ও মূর্তি পূজা সম্পর্কে। 

যজুর্বেদের ৩২ নং অধ্যায়ের ২ নং শ্লোকে আছে - 'ন তস্য প্রতিমা অস্তি।' অর্থাৎ... 'স পরমেশ্বর অখণ্ড ও অদ্বিতীয়, এজন্য তাঁর প্রতিমা বা প্রতিকৃতি নেই।'

যজুর্বেদের ৪০ নং অধ্যায়ের ৭ নং শ্লোকে আছে - 'স পরযগাছ ক্রমকায়মব্রণ মস্রাবিরং 'অর্থাৎ... 'তিনি প্রাকৃত শরীররহিত, অক্ষত, স্নায়ুরহিত'

যজুর্বেদের ৪০ নং অধ্যায়ের ৮ নং শ্লোকে আছে - 'অন্ধং তমঃ প্রবিণন্তি যে হ সংভূতিমপাসতে।' অর্থাৎ... 'যারা অবিদ্যা কাম্য কর্মের বীজস্বরূপ প্রকৃতির উপাসনা করে,তারা অন্ধকার সংসারে প্রবেশ করে।' এর অর্থ--- যারা জল, বায়ু, অগ্নি, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদি প্রাকৃতিক জিনিসের উপাসনা করে তারা অন্ধকারে পতিত হয়।

ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডল, ১৬৪ সূক্ত, ৪৬ নং শ্লোকে আছে-- 'একং সদ্ধিপ্রা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং...'। সরলার্থ--- ঋষিরা এক ঈশ্বরকে বহু নামে ডাকেন। সত্য হল এক। এক ঈশ্বর। ঋষিরা একে বহু নামে ডাকেন। ঋগ্বেদে সর্বশক্তিমান স্রষ্টার প্রায় তেত্রিশটি ভিন্ন ভিন্ন গুনের কথা প্রকাশিত হয়েছে। 

ব্রহ্মা = স্রষ্টা : ঋগ্বেদ, দ্বিতীয় মণ্ডল, সূক্ত ১, শ্লোক ২--- সর্বশক্তিমান স্রষ্টাকে ঋগ্বেদে কখনও কখনও ব্রহ্মা বলা হয়েছে। ব্রহ্মা’ শব্দটির অর্থ ‘স্রষ্টা। এর আরবি প্রতিশব্দ হল ‘খালিক'। ইসলামে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে খালিক বলা হয়। বেদে বলা হয় ব্রহ্মা। কিন্তু প্রশ্ন হল, ব্রহ্মার চারটি মাথার কল্পনা কোথা থেকে এল? 

যজুর্বেদের ৩২নং অধ্যায়ের ২নং শ্লোকে আছে-- ‘ন তস্য প্রতিমা অস্তি।' সরলার্থ—“অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের কোনও প্রতিমা বা প্রতিকৃতি নেই।' অর্থাৎ, পরমেশ্বরের চারটি মাথার কল্পনা এই শ্লোকের পরিপন্থী। 

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের ১০নং শ্লোকে আছে— ‘তদরূপমনাময়'। সরলার্থ—“তিনি অরূপ (নিরাকার) ও অনাময় (নীরোগ)।' ধর্মগ্রন্থে যাঁকে অরূপ বা নিরাকার বলা হল, পরবর্তীকালে তাকে চারটি মাথাযুক্ত শরীরী অবয়ব দান করা হল কোন উদ্দেশ্যে?

বিষ্ণু = রক্ষাকারী বা পালনকর্তা : ঋগ্বেদ, দ্বিতীয় মণ্ডল, সূক্ত ১, শ্লোক ৩... সর্বশক্তিমান স্রষ্টাকে ঋগ্বেদে কখনও কখনও বিষ্ণু বলা হয়েছে। 'বিষ্ণু’ শব্দের অর্থ রক্ষাকারী বা পালনকর্তা। এর আরবি প্রতিশব্দ হল ‘রব’। বিষ্ণুকে যদি স্রষ্টা ভাবা হয় তাহলে তার চারটি বাহুর কল্পনা করা হল কেন? 

তার কোনও বাহুতে ‘চক্র’, আবার কোনও বাহুতে ‘শঙ্খ’ এল কোথা থেকে? যাঁর কোনও রূপ নেই, সেই সর্বশক্তিমান স্রষ্টাকে রূপের বাঁধনে বাঁধা, ইসলামে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। শুধু ইসলামে সেটা নিষিদ্ধ নয়, উপনিষদে সেটা নিষিদ্ধ, শ্রীমদ্ভাগবতেও সেটা নিষিদ্ধ।

উপনিষদে আছে-- দিব্যো হ্যমূর্তঃ পুরুষঃ সবাহ্যাভ্যন্তরে হ্যজঃ। অপ্রাণা হ্যমনঃ শুভদ্রা হ্যক্ষরাৎ পরতঃ পরঃ।। (মুণ্ডক উপনিষৎ : দ্বিতীয় মুণ্ডক : প্রথম খণ্ড : শ্লোক ২)।

সরলার্থ—“সেই জ্যোতিঃস্বরূপ পুরুষের কোনও মূর্তি বা আকার নেই। তিনি বাইরে ও ভিতরে সর্বত্র বিদ্যমান, তিনি জন্মরহিত এবং প্রাণের ক্রিয়াবর্জিত, ইন্দ্রিয়ের প্রধান মনও তার নেই। তিনি শুদ্ধ এবং স্থূল প্রকৃতি হতে | শ্রেষ্ঠ যে অব্যাকৃত প্রকৃতি (অক্ষর) তা হতেও শ্রেষ্ঠ।” (উপনিষদ , রণব্রত সেন , পৃষ্ঠা - ২৬৩)

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে আবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে-- ‘য একোহবর্ণো...” সরলার্থ– সর্বশক্তিমান স্রষ্টা এক এবং বর্ণরহিত (তার কোনও রূপ নেই)। (ওই, পৃষ্ঠা ৪০৭) যাঁর রূপ নেই, তার প্রতিকৃতিও নেই, তার প্রতিমাও নেই।

শ্রীমদ্ভাগবতে আছে— অহং সর্বেষু ভূতেষু ভূতাত্মবস্থিতঃ সদা। তমবজ্ঞায় মাং মত্যঃ কুরুতে হর্চা বিড়িম্বনম।।২১ যমাং সর্বেষু ভূতেষু সন্ত মাত্মানমীশ্বরম। হিত্বাৰ্চাং ভজতে মৌঢ়েঢ়ুস্মন্যব ভূজুহতিসঃ।।২২ 

সরলার্থ– “ভগবানই সর্বভূতে বর্তমান এবং সকল প্রাণীর আত্মা তথা অধীশ্বর। তাঁকে মূঢ়তাবশত পরিত্যাগ করে প্রতিমাপূজা ভস্মে ঘৃতাহুতি নিক্ষেপের মত বিফল প্রচেষ্টা। এ ধরনের লক ঈশ্বরবিদ্বেষী এবং বৃথাভিমানী, ভিন্নদর্শী এবং সর্বভূতের জাতবৈরী জীব। সে শান্তি পায় না।”

(শ্রীমদ্ভাগবত, ৩য় স্কন্ধ, ২৯ অধ্যায় ; সম্পাদনা : রণব্রত সেন , পৃষ্ঠা -১৫৪) 

এখানে স্পষ্টই ঘষণা করা হল যারা প্রতিমা পূজা করেন তাঁরা ‘ঈশ্বরবিদ্বেষী'। তারা পৃথিবীতে শান্তি পাবেন না, মৃত্যুর পরেও শান্তি পাবেন না। ইসলামেও প্রতিমাপূজাকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘষণা করা হয়েছে। আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতেও তার একত্বের কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে বারে বারে।

আলকিত বধ নিয়ে কেউ যদি উভয় ধর্মের ধর্মগ্রন্থসমূহ পাঠ করেন তাহলে তিনি দুটি ধর্মের গভীরে প্রবাহিত অন্তর্নিহিত সাদৃশ্যের ফল্গুধারাটি উপলব্ধি করতে পারবেন। অংশীবাদিত্বের পলিকেও তিনি অনায়াসে দুরীভূত করতে পারবেন। দেখবেন, দুটি ধর্মেই একেশ্বরবাদের কথা আছে— আছে ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তার কোনও আকার নেই—তিনি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন- তার কোনও উপমা নেই।

ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের সাদৃশ্য - সূচিপত্র।