ঈশ্বর বা আল্লাহ্‌র গুণাবলি।

অনেক নন-সেমেটিক ধর্মে আছে ঈশ্বরের উপর মানবত্ব আরোপের দর্শন। অর্থাৎ সেখানে মনে করা হয় যে ঈশ্বর মানবদেহ ধারণ করে মর্ত্যে আগমন করেন। যাঁরা এই মত বিশ্বাস করেন তারা একটি সুন্দর যুক্তি খাড়া করেন। 

তারা বলেন যে ঈশ্বর অপাপবিদ্ধ, পবিত্র। তাই তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্ট, ত্রুটি, দুর্বলতা, সুবিধা-অসুবিধা, আবেগ-অনুভূতি, প্রলোভন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।

তিনি জানেন না একটা মানুষ যখন আহত হয় অথবা দুঃখে পড়ে তখন তার অনুভূতিটা কেমন হয়। মানুষের মনের সেই অজানা অনুভূতি জানার জন্য এবং মানুষের আচরণবিধি নির্ধারণের জন্য ঈশ্বর নেমে আসেন মাটির পৃথিবীতে, মানুষের আকৃতিতে। এখন আসুন আমরা অ্যানথ্রোপমরফিজমের প্রবক্তাদের এই মতটা বিশ্লেষণ করি।

সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর বা আল্লাহ একটি ম্যানুয়াল বা সারগ্রন্থ রচনা করেন।

ঈশ্বর বা আল্লাহ্‌র গুণাবলি।

ধরুন, আমি একটি মোবাইলের প্রস্তুতকারক। এখন প্রশ্ন হল, মোবাইলের ভালোমন্দ বুঝতে গেলে আমাকে কি মোবাইল হতে হবে? নিশ্চয়ই নয়। মোবাইলকে বুঝতে গেলে প্রস্তুতকারককে নিশ্চয় মোবাইলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয় না। প্রস্তুতকারক মোবাইল তৈরির সঙ্গে সঙ্গে একটি ম্যানুয়্যাল বা সারগ্রন্থ রচনা করেন।

তাতে ব্যবহারকারীদের উদ্দেশে লেখা থাকে— “যদি ফন করতে চান" তাহলে নম্বারটি ডাইল করুন এবং ‘কোল’ বোতামটি টাচ করুন। যদি কোল থামাতে চান তাহলে ‘লাল' বোতামটি টাচ করুন। যদি ইন্টারনেট চালাতে চান তাহলে গুগলে গিয়ে সাঁচ করুন ।

 উঁচু থেকে একে ফেলে দেবেন না তাহলে এ ভেঙে যাবে। জলে ডোবাবেন না, তাহলে এ নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ, প্রস্তুতকারকের তৈরি ম্যানুয়াল বা সারগ্রন্থে ‘করো এবং করো না’ জাতীয় নির্দেশিকা থাকে।

পবিত্র কোরআন মানুষের জন্য একটি ম্যানুয়াল বা সারগ্রন্থ স্বরূপ।

অনুরূপভাবে নিখিল জগতের প্রতিপালক সর্বশক্তিমান স্রষ্টা মহান আল্লাহ মানুষের ভালােমন্দ বােঝার জন্য মানুষের চেহারায় পৃথিবীতে নেমে আসেন না। সমগ্র বিশ্বকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি সৃষ্টির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু, পরমাণু সম্পর্কেও সম্যক অবগত।

সৃষ্টির সমস্ত কিছু তারই নিয়ন্ত্রণাধীন—তিনি পরম প্রজ্ঞাময়। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন—তাই মানুষের ভালাে এবং মন্দ কীসে নিহিত আছে তা একমাত্র তিনিই জানেন। মানুষের উপকারার্থে তিনি তার সারগ্রন্থে নির্দেশিকা রচনা করেছেন। 

সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন- মানব জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কী। কে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এবং অনন্ত সাফল্য পেতে গেলে মানুষের কী করা উচিত এবং কীসের থেকে বিরত থাকা উচিত। মহিমান্বিত মহাগ্রন্থ কোরআন হচ্ছে মহান স্রষ্টার তরফ থেকে শেষ এবং চূড়ান্ত নির্দেশিকা বা সারগ্রন্থ।

ঈশ্বর, আল্লাহ বার্তাবাহক বা রসূলদের মনােনীত করেছেন।

আল্লাহকে নেমে এসে ম্যানুয়াল বা সারগ্রন্থ লিপিবদ্ধ করার প্রয়ােজন হয়নি। তিনি মানুষের মধ্যে থেকে মানুষকে মনােনীত করেছেন তার বাণী মানুষের মধ্যে পৌছে দেওয়ার জন্য। 

এই মনােনীত ও পছন্দনীয় ব্যক্তিরাই হলেন আল্লাহর রসূল। তারা আল্লাহর প্রত্যাদেশের আলােকিত বৈভব মানুষের মাঝে অকাতরে বিতরণ করেন।

আল্লাহ মানুষের আকৃতি গ্রহণ করেননি এবং গ্রহণ করবেন না। কোনও মানুষ হয়তাে তর্ক করতে পারেন, আল্লাহ তাে সব কিছু করতে পারেন, তাহলে তিনি কি মানুষের আকৃতি গ্রহণ করতে পারেন না?

এর উত্তরে বলব, আল্লাহ যদি মানুষের আকৃতি গ্রহণ করতেন তাহলে তিনি আর আল্লাহ থাকতে পারতেন না (নাউজুবিল্লাহ), কারণ আল্লাহর গুণাবলি এবং মানুষের গুণাবলি সম্পূর্ণ আলাদা।

ঈশ্বর, আল্লাহ অবিনশ্বর, মানুষ মরণশীল।

আল্লাহ্ অমর, অবিনশ্বর, মানুষ মরণশীল। কেউ একই সঙ্গে অমর আবার একই সঙ্গে মরণশীল হতে পারে না। এটা অর্থহীন। আল্লাহর শুরু নেই, মানুষের কিন্তু শুরু আছে। আল্লাহর শেষ নেই, মানুষের শেষ আছে। একটি সত্তার একই সঙ্গে সমাপ্তি নেই—আবার সমাপ্তি আছে—ব্যাপারটা অর্থহীন এবং অবান্তর।

ঈশ্বর, আল্লাহর আহার করার প্রয়োজন হয় না।

আল্লাহর আহার করার প্রয়োজন হয় না, মানুষের কিন্তু আহার করার প্রয়োজন হয়। সূরা আনআমে আছে “তিনিই সকলকে আহার দান করেন, কিন্তু তাকে কেউ আহার করায় না।” (৬ নং সূরা , আয়াত ১৪)

ঈশ্বর, আল্লাহর বিশ্রাম নেওয়ার বা নিদ্রা যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

আল্লাহ বিশ্রাম নেন না, মানুষ বিশ্রাম নেয়। আল্লাহ নিদ্রা যান না, মানুষ নিদ্রা যায়। পবিত্র কোরআনের আয়াতুল কুরসি অংশে আছে - “আল্লাহ! তিনি ছাড়া অন্য কোনও উপাস্য নেই। 

তিনি চিরঞ্জীব, অনাদি। তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশ, পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তার।” (সূরা বাকারাহ : ২ নং সূরা , আয়াত ২৫৫)

ঈশ্বর বা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য মানুষের পূজা করা অর্থহীন।

ঈশ্বর যদি মানুষের আকৃতি গ্রহণ করেন, তাহলে তিনি দেবতায় পরিণত হন। বস্তুত মানুষ হয়ে একজন মানুষকে পূজা করা অর্থহীন। ধরুন, আমি এক বিচক্ষণ শিক্ষকের ছাত্র। আমি নিয়মিত তার কাছে পাঠ গ্রহণ করি, তার অভিভাবকত্বে পথ চলি। 

দুর্ভাগ্যবশত সেই শিক্ষক একদিন দুর্ঘটনায় পড়লেন এবং দুরারোগ্য স্মৃতি ভ্রষ্টতায় আক্রান্ত হলেন। এই অবস্থায় আবার তার কাছে পাঠ গ্রহণ করা ও তার অভিভাবকত্বে পথ চলা কি ঠিক হবে ? নিশ্চয়ই নয়।

কারণ সেই শিক্ষক স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার কারণে। তার বিশেষ দক্ষতা ও প্রজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছেন। অনুরূপভাবে একজন মানুষ কীভাবে একজন দেবতার পূজা করতে পারেন যিনি অমরত্ব ও অবিনশ্বরতা ত্যাগ করে নশ্বর মানবদেহ গ্রহণ করেছেন? 

মানুষ যদি মানুষকে পূজা করবে তাহলে আপনাকে অন্যরা পূজা করে না কেন ? চারপাশের অসংখ্য মানুষকে সবাই পূজা করে না কেন?

মানুষ কখনও ঈশ্বর বা আল্লাহ হতে পারে না।

একই সত্তা একই সময়ে কখনও ঈশ্বর আবার কখনও মানুষ হতে পারে না। যদি ঈশ্বর তার স্বর্গীয় ক্ষমতা ধরে রাখতে চান তাহলে তিনি মানুষ হতে পারেন না, কারণ মানুষের স্বর্গীয় ক্ষমতা নেই। যদি ঈশ্বর মানুষের মতো মরণশীল হতে চান তাহলে তিনি আর ঈশ্বর থাকতে পারেন না।

অনুরূপভাবে মানুষও ঈশ্বর হতে পারে না, কারণ মানুষ মরণশীল—সে কখনোই অমর নয়। তাই মহান স্রষ্টা কখনও মানুষের আকৃতি গ্রহণ করেন না। কোরআনে স্রষ্টার মানবত্বের বিরোধিতা করা হয়েছে। স্রষ্টার মানবত্ব সম্পূর্ণ অনৈতিক, ভ্রান্ত।

সমস্ত কিছুর উপরেই ঈশ্বর বা আল্লাহর ক্ষমতা বর্তমান।

ইসলাম কখনও বলেনি যে আল্লাহ সমস্ত কিছু করে দেন। বরং ইসলাম বলে যে, সমস্ত কিছুর উপরেই আল্লাহর ক্ষমতা বর্তমান। আল্লাহ অনৈতিক কাজ করেন না। আসুন, কয়েকটা উদাহরণ নেওয়া যাক।

আল্লাহ কখনও মিথ্যা বলেন না। আল্লাহ সর্বদা সঠিক কাজ করেন, তিনি অনৈতিক কাজ করেন না। তিনি কখনও মিথ্যা বলেন না। তিনি কখনও মিথ্যা বলতে পারেন না, কারণ মিথ্যা তার সত্তার পরিপন্থী।

আল্লাহ কখনও অবিচার করেন না। আল্লাহ কখনও অবিচার করেন না, কখনও ভুল সিদ্ধান্তও নেন না, কারণ অবিচার এবং ভুল আল্লাহর সত্তার পরিপন্থী। সূরা নিসা’য় আছে— “নিশ্চয় আল্লাহ অণু পরিমাণও জুলুম করেন না,(৪ নং সূরা , আয়াত ৪০)

আল্লাহ কখনও ভুল করেন না। শ্রেষ্ঠতম উৎকর্ষতা স্রষ্টার গুণ। মানুষ কখনও নিখুঁত কাজ করতে পারে না—মানুষ প্রতিদিন নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করে—কিন্তু চরম উৎকর্ষতা লাভ করতে পারে না।

 মানুষের স্বভাব ভুল করা, কিন্তু আল্লাহ কখনও ভুল করেন না ‘সুরা ত্বাহায় আছে - ‘আমার প্রতিপালক ভুল করেন না এবং তিনি ভুলেও যান না।(২০ নং সূরা , আয়াত ৫২)

আল্লাহ যা চান সেটাই করেন। ‘সূরা বুরূজ’-এ আছে –‘তিনি যা চান তা-ই করেন। (৮৫ নং সূরা , আয়াত ১৬)। তিনি খারাপ কিছু চান না, তিনি মানুৰ্যের মঙ্গল চান, মানুষের ভালো চান। মানুষকে ভালোবেসেই তিনি সৃষ্টি করেছেন, তাই তার সৃষ্টিশীলতার মধ্যে ছড়িয়ে আছে ভালোবাসার শুভানুধ্যান। 

ভুলে যাওয়া, ভুল করা, ক্লান্ত হওয়া, ঈর্ষাকাতর হওয়া, ক্ষুধার্ত হওয়া ইত্যাদি মানবিক গুণাগুণ যদি তার উপর আরোপ করা হয় তাহলে তাকে উপহাস করা হয়। তাঁকে নিন্দা করা হয়। তাকে অপমান করা হয়। মানবিক যে কোনও কলঙ্ক থেকে তাকে মুক্ত করাই হল তাঁর প্রতি আনুগত্যের আন্তরিক শ্রদ্ধার্ঘ্য।

ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের সাদৃশ্য - সূচিপত্র।