হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মহাপুরুষ বা অবতার।

নিখিল জগতের প্রতিপালক সর্বশক্তিমান আল্লাহ রসূল,পয়গম্বর, মহাপুরুষ, বা অবতার হিসেবে তার কিছু প্রিয় বান্দাকে মনোনীত করেছেন, যাঁরা তাঁর বাণীকে মানুষের মাঝে পৌঁছে দিয়েছেন যুগে যুগে দেশে দেশে।

হিন্দু  ও ইসলাম ধর্মের মহাপুরুষ বা অবতার।

রসূল, মহাপুরুষ, বা অবতার পাঠানো হয়েছিল প্রতিটি জাতির মধ্যে।

পরম করুণাময় আল্লাহ ‘সূরা ইউনুসে’ ঘোষণা করেছেন “প্রত্যেক জাতির জন্যে আছে একজন রসূল এবং যখন ওদের রসূল এসেছে তখন ন্যায়বিচারের সঙ্গে ওদের মীমাংসা হয়েছে এবং ওদের প্রতি জুলুম করা হয়নি।” (১০ নং সূরা , আয়াত ৪৭)

‘সুরা নাহল’-এ পরম প্রজ্ঞাময় সর্বশক্তিমান আল্লাহ আবারও জানিয়েছেন “আর আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছিলাম এই বলে যে, তোমরা আল্লাহর উপাসনা করো এবং অসৎ (বিশৃঙ্খলা) বর্জন করে। 

অতঃপর তাদের কতিপয়কে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছিলেন এবং কতিপয়ের সংগতভাবেই পথভ্রান্তি হয়েছিল। সুতরাং পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং দেখো যারা সত্যকে মিথ্যা বলেছে তাদের পরিণাম কী হয়েছে।” (১৬ নং সূরা , আয়াত ৩৬)

‘সুরা ফাত্বির’-এ মহান আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন – “আমি তো তোমাকে সত্যসহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি- এমন কোনও সম্প্রদায় নেই যার কাছে সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি।” (৩৫ নং সুরা , আয়াত ২৪)

এই একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে ‘সুরা রা'দ’-এ -“তুমি তো কেবল সতর্ককারী, এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য পথ-প্রদর্শক আছে।” (১৩ নং সুরা , আয়াত ৭)

কিছু নবি, রসূল, মহাপুরুষ, বা অবতারের নাম উল্লিখিত হয়েছে কোরআন ও হাদিসে।

হজরত আদম (আঃ), হজরত শীশ (আঃ), হজরত ইদ্রিস (আঃ), হজরত নূহ (আঃ), হজরত হুদ (আঃ), হজরত সালিহ (আঃ), হজরত লুত (আঃ), হজরত ইব্রাহিম (আঃ), হজরত ইসমাইল (আঃ), হজরত ইসহাক (আঃ), হজরত ইয়াকুব (আঃ), হজরত ইউসুফ (আঃ), হজরত শোয়াইব (আঃ), হজরত দাউদ (আঃ), হজরত সুলাইমান (আঃ), হজরত ইলিয়াস (আঃ), হজরত আল-য়াস (আঃ), হজরত মুসা (আঃ),হজরত আজিজ (আঃ), হজরত আইয়ুব (আঃ), হজরত দুলকিফল (আঃ), হজরত ইউনুস (আঃ), হজরত যাকারিয়া (আঃ), হজরত ইয়াহইয়া (আঃ), হজরত ঈশা (আঃ), হজরত মহম্মদ (সাঃ)।

কিছু নবী, মহাপুরুষ, বা অবতারের কাহিনী উল্লিখিত হয়েছে কোরআনে।

সূরা নিসায় পরম প্রজ্ঞাময় মহান আল্লাহ জানিয়েছেন – “অনেক রসূল (প্রেরণ করেছি। যাদের কথা পূর্বে তোমাকে বলেছি এবং অনেক রসূল যাদের কথা তোমাকে বলিনি। এবং মূসার সঙ্গে আল্লাহ সাক্ষাৎ বাক্যালাপ করেছিলেন।”(৪ নং সূরা , আয়াত ১৬৪)

প্রায় একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে ‘সূরা মুমিন’-এ : “আমি তো তোমাকে পূর্বে অনেক রসূল প্রেরণ করেছিলাম; তাদের কারও কারও কথা তোমার কাছে বিবৃত করেছি এবং কারও কারও কথা তোমার কাছে বিবৃত করিনি।” (৪০ নং সূরা , আয়াত ৭৮)

আল্লাহ এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী, মহাপুরুষ, বা অবতার পাঠিয়েছিলেন বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ মিস্কাতুল মাসাবিহ-তে আছে - ‘আল্লাহ ১,২৪,০০০ নবি পাঠিয়েছিলেন (৩ অধ্যায় : হাদিস নং ৫৭৩৭)

পূর্ববর্তী নবী, মহাপুরুষ, বা অবতার পাঠানো হয়েছিল কেবলমাত্র তাদের জনগোষ্ঠীর জন্য।

হজরত মহম্মদ (সাঃ)-এর আগে যত নবি ও রসূল এসেছিলেন, তারা প্রেরিত হয়েছিলেন তাদের নিজস্ব জনগোষ্ঠী ও তাদের নিজস্ব জনপদের জন্য। তাদের উপদেশমালা কেবলমাত্র সেই সময়ের জন্য প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু শেষ নবি হজরত মহম্মদ (সাঃ)-কে পাঠানো হয়েছিল সর্ব কালের, সর্ব দেশের সকল মানুষের জন্য—আর সেই জন্যই তিনি বিশ্বনবি।

মহম্মদ (সাঃ) ছিলেন শেষ মহাপুরুষ, অবতার, আখেরি নবি।

‘সূরা আহযাব’-এ আছে --- “মহম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনও পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রসূল ও শেষ নবি। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞ।”(৩৩ নং সূরা , আয়াত ৪০) মহম্মদ (সাঃ) -কে পাঠানাে হয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য।

‘সূরা আম্বিয়ায় আছে : - “আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল আশিস(রহমত)রূপেই প্রেরণ করেছি।”(২১ নং সুরা , আয়াত ১০৭)

সারা বিশ্ব তো তার জন্য অপেক্ষা করেছিল আশীর্বাদের আলো গ্রহণ করবে বলে। তিনি সর্বদেশের বিভাজনরেখা উপেক্ষা করে মানুষকে বিশ্বনাগরিক করে তুলেছিলেন। দেশ-কাল-পাত্রের ব্যবধান ঘুচে গিয়েছিল তার আলোকিত আহ্বানে। আঞ্চলিকতাকে ছাড়িয়ে তিনি বিশ্বজনীন ও সর্বকালীন হয়েছিলেন বলেই তিনি বিশ্বনবি। টমাস কার্লাইল তাকে ‘নায়ক নবি’ বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি লিখেছেন :

"I said the great man was a lighting out of heaven, the rest of men waited for him like fuel and then they would flame.”(Muhammad as a Hero : Pages 70-71)

“আমি বলব, এই মহান মানুষটি ছিলেন জান্নাত থেকে বেরিয়ে আসা একটি আলো; বাকি মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছিল ঠিক তেমনিভাবে যেমন জালানি অপেক্ষা করে(আগুনের) এবং তারপর তারা দীপ্তিময় হয়ে উঠল।”

‘সুরা সা-বা’য় আছে - “আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ উপলব্ধি করে না।” (৩৪ নং সুরা , আয়াত ২৮)

বুখারি শরিফে আছে – নবি (সাঃ) বলেছেন, প্রত্যেক নবিকে পাঠানো হয়েছিল তাঁর জাতির জন্য, কিন্তু আমাকে পাঠানো হয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য। (প্রথম খণ্ড : অধ্যায় ৫৬ : হাদিস ৪২৯)

হিন্দুধর্মের মহাপুরু বা অবতার।

সাধারণ হিন্দুদের মতে অবতার।

সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে অবতার সম্পর্কে নিম্নোক্ত ধারণা বর্তমান। সংস্কৃত ‘অবতার’ শব্দটি ভাঙলে পাওয়া যায় ‘অব’ ও ‘তার’। অব’-এর অর্থ ‘নিম্ন’ এবং ‘তার’-এর অর্থ ‘অবতরণ’। তাই ‘অবতারে’র পূর্ণ অর্থ নিম্নে অবতরণ”। Oxford Dictionary'-তে “Avatar'-এর যে অর্থ আছে তা হল এই রকম : “(In Hindu mythology) descent of a deity or released soul to earth in bodily form.”

অর্থাৎ, হিন্দুপুরাণ অনুযায়ী অবতারের অর্থ হচ্ছে, কোনও দেবদেবী বা মুক্ত আত্মার দেহধারণ করে মর্ত্যে আগমন।সাধারণ হিন্দুরা একে সহজ করে ভাবেন। ভগবান মানবদেহ ধারণ করে যখন মর্ত্যে আগমন করেন, তখনই একজন অবতারের আবির্ভাব ঘটে।

সাধারণ হিন্দুরা মনে করেন, ধর্ম রক্ষা করার জন্য, উদাহরণ সৃষ্টির জন্য অথবা মানবজীবনের নিয়মনীতি নির্ধারণের জন্য ভগবান দেহধারণ করে মাটির পৃথিবীতে নেমে আসেন। হিন্দুদের ‘শ্রুতি’ পর্যায়ের সবচেয়ে প্রামাণিক ও পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বেদে কিন্তু অবতারের উল্লেখ নেই। অবতারের উল্লেখ আছে ‘স্মৃতি’ পর্যায়ের গ্রন্থ পুরাণ ও মহাকাব্যে।

অবতারের কথা আছে হিন্দুদের জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত ধর্মগ্রন্থে।

ভাগবদ্গীতার ৪ অধ্যায়ের ৭-৮ শ্লোকে আছে - “যখনই যেখানে ধর্মপ্রাণতার অভাব ঘটে, অধর্ম উত্থিত হয়, তখন সেখানে আমি প্রকাশিত হই। ভালোকে রক্ষা করার জন্য,খারাপকে বিনাশ করার জন্য এবং ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি প্রতিটি যুগেই জন্মগ্রহণ করি।”

ভাগবত পুরাণে (৯ : ২৪ : ৫৬) আছে – “যখন ধর্মপ্রাণতার অবনতি ঘটে এবং যখন পাপ বৃদ্ধি পায়, তখন গৌরবময় প্রভুর আবির্ভাব ঘটে।”

বেদ এবং ইসলামে অবতারের কোনও প্রসঙ্গ নেই, আছেন বার্তাবাহক।

ইসলাম কখনও বিশ্বাস করে না যে সর্বশক্তিমান স্রষ্টা মানবদেহ ধারণ করে মানুষের মাঝে অবতরণ করেন। বরং তিনি মানুষের মধ্য থেকে মানুষকে মনোনীত করেন তার বার্তাবাহক হিসেবে এবং সেই বার্তাবাহক বা পয়গম্বরের মাধ্যমে তার বাণী পৌঁছে দেন সমস্ত মানুষের মধ্যে। এই বার্তাবাহককে বলা হয় আল্লাহর রসূল।

আগেই বলেছি, ‘অবতার’ শব্দের অর্থ নিম্নে অবতরণ। পণ্ডিতরা অবশ্য মনে করেন ‘নিম্নে অবতরণ’ মানে আকাশ থেকে পড়া নয়। অবতার মানুষের মধ্যে থেকেই মনোনীত হন এবং তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করেন। বেদের বিভিন্ন জায়গায় এই মনোনীত মহাপুরুষদের কথা বলা হয়েছে।

যদি আমরা ভাগবদ্গীতা ও পুরাণের সঙ্গে বেদের সামঞ্জস্যপূর্ণ আলোচনা করি তাহলে দেখব ভাগবদ্গীতা ও পুরাণে অবতার বলতে আসলে মনোনীত মহাপুরুষদের বোঝানা হয়েছে। ইসলামে মনোনীত মহাপুরুষদের রসূল বলা হয়।

ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের সাদৃশ্য - সূচিপত্র।