ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে মৃত্যুর পর কি হয়।

হিন্দুধর্মে মৃত্যুর পরের জীবন।

(১) হিন্দুধর্মে পুনর্জন্ম বা আত্মার দেহান্তরপ্রাপ্তি।

অধিকাংশ হিন্দু জন্ম, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন। বিশ্বাস করেন, আত্মার দেহান্তরপ্রাপ্তির মতবাদে। এই মতবাদে আছে, মানুষের অতীত ‘কর্মফল' অনুযায়ী জন্মলগ্নে মানুষে মানুষে বিভাজন রচিত হয়। 

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটা শিশু হয়তো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে জন্মগ্রহণ করল, অন্য শিশু হয়তো বিকলাঙ্গ বা অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করল। 

জন্মলগ্নের এই পার্থক্যের কারণ হল তাদের পূর্ব ‘কর্ম'। তবে পার্থক্য যতই থাক প্রতিটি মানুষ কিন্তু তাদের পূর্বজন্মের পাপমোচনের সুযোগ পেতে পারে নবজন্মে।

ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে মৃত্যুর পর কি হয়।

এটি উল্লিখিত হয়েছে ভাগবদ্গীতায় (২ : ২২) –

“যেমন একজন মানুষ পুরনো পোশাক পরিত্যাগ করে নতুন পোশাক পরিধান করে, আত্মা তেমনি পুরনো দেহ ত্যাগকরে নতুন দেহ গ্রহণ করে।”

পুনর্জন্মের মতবাদ বৃহদারণ্যক উপনিষদেও (৪ : ৪ : ৩) আছে -

“যেমন একটা শুয়োপোকা কিলবিল করে ঘাসের ডগার উপরে উঠে একটি ঘাসের ডগা থেকে অন্য একটি ডগায় যায়, তেমনি আত্মা পুরনো শরীরকে ছেড়ে নতুন অস্তিত্বে প্রবেশ করে।”

(২) কর্ম : কার্যকারণ ও ফলের সূত্র।

‘কর্মে'র অর্থ কাজ। দেহ দ্বারা যে কাজ সম্পাদিত হয় এখানে শুধু সেই কাজের কথা বলা হয়নি, বরং মন দ্বারা যে কাজ সংঘটিত হয় এখানে সেই কাজের কথাও বলা হয়েছে। 'কর্ম’ আসলে হল কার্যকারণ এবং ফলের সূত্র। কথায় বলে 'যেমন কর্ম তেমনি ফল'। 

চাষি যদি গম বপন করে, তাহলে ধানের আশা করতে পারে না। অনুরূপভাবে সৎচিন্তা এবং সৎকর্ম শুভফল প্রদান করে যা পরকালেও সৌভাগ্যের কারণ হয়। কিন্তু কু-চিন্তা, কু-বাক্য, কু-কর্ম ইহকালে এবং পরকালে অশুভ ফল বয়ে আনে।

(৩) ধর্ম : পবিত্র কর্তব্য।

‘ধর্ম' কথাটির অর্থ সঠিক ও পবিত্র কর্তব্য। এই পবিত্র কর্তব্য শুধু ব্যক্তিবিশেষের জন্য সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, এই কর্তব্য ছড়িয়ে দিতে হবে পরিবার, জাতি এবং সমগ্র বিশ্বের মাঝে। শুভ 'কর্ম’ লাভ করতে গেলে ‘ধর্ম'-অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে, নতুবা ফল অশুভ হবে। 'কর্ম’ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় জীবনকেই প্রভাবিত করে।

(৪) মোক্ষ : পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি।

‘মোক্ষ’ কথাটির অর্থ হল পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি। প্রতিটি হিন্দুর চরম লক্ষ্য হচ্ছে একদিন না একদিন পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি লাভ করা। এটা ঘটবে তখনই যখন মানুষ শুভকর্ম করবে—অশুভ বা কুকর্ম করলে তাকে পুনর্জন্মের চক্রে আবর্তিত হতে হবে।

(৫) পুনর্জন্মের কথা বেদে উল্লিখিত হয়নি।

পুনর্জন্মের কথা বেদে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়নি, এমনকি উল্লিখিতও হয়নি। অথচ বেদ হিন্দুদের সবচেয়ে প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থ। আত্মার দেহান্তরপ্রাপ্তির কথাও বেদে নেই।

(৬) পুনর্জন্ম বলতে পৃথিবীতে আবার জন্ম নয়, বরং মৃত্যুর পরের জন্মকে বোঝানো হয়েছে ।

সংস্কৃত ‘পুনঃ’ শব্দটির অর্থ ‘পরের বার’ বা ‘আবার’। আর ‘জন্ম’ মানে ‘জীবন ধারণ'। তাই ‘পুনর্জন্ম’-এর অর্থ ‘আবার জীবন ধারণ’। এর অর্থ অবশ্য আবার পৃথিবীতে জীবন্ত প্রাণী হিসেবে ফিরে আসা নয়।

যদি কেউ বেদকে পাশে রেখে হিন্দুধর্মে পুনর্জন্মের ব্যাপারটি অধ্যয়ন করেন, তাহলে তিনি অনায়াসে বুঝতে পারবেন যে পুনর্জন্ম বলতে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসার কথা বোঝানো হয়নি, বরং পরকালের জন্মকে বোঝানো হয়েছে।

পুনর্জন্মের কথা প্রাচীন ও প্রামাণিক বেদে নেই। একথা আছে অধিকতর নবীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে। ওই সব ধর্মগ্রন্থের রচয়িতারা উপলব্ধি করেছিলেন যে ঈশ্বর তো কখনও অবিচার করেন না অথচ জন্মলগ্নে মানুষে মানুষে পার্থক্য রচিত হয়। এই পার্থক্যের কারণ তাদের পূর্ব কমফল। ইসলাম এর বুদ্ধিদীপ্ত এবং যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিয়েছে।

(৭) বেদ-এ মৃত্যুর পরের জীবন।

বেদে মৃত্যুর পরের জীবনের কথা উল্লিখিত হয়েছে।

ঋগ্বেদ-এ আছে :

“এ মৃত্যব্যক্তির যে অংশ অজ অর্থাৎ জন্মরহিত, চিরকালই আছে, হে অগ্নি! তুমি সে অংশকে তোমার তাপ দ্বারা উত্তপ্ত করো, তোমার শিখা সে অংশকে উত্তপ্ত করুক। হে জাতবেদা বহ্নি! তোমার যে সকল মঙ্গলময়ী মূর্তি আছে, তাদের দ্বারা এ মৃত্যব্যক্তিকে পুণ্যবান লোকদের ভুবনে বহন করে নিয়ে যাও।” (১০ মণ্ডল; ১৬ সূক্ত; শ্লোক ৪ : অনুবাদ : রমেশচন্দ্র দত্ত :পৃ. ৪৫৯)

‘সুকৃতামু লোকম’–এই সংস্কৃত শব্দদ্বয়ের অর্থ ‘পুণ্যবান লোকদের ভুবন' যা পরকাল বা স্বৰ্গকেই ইঙ্গিত করে।

ঋগ্বেদে এর পরবর্তী শ্লোকে আছে :

“হে অগ্নি! যে তোমার আহুতিস্বরূপ হয়ে যজ্ঞের দ্রব্য ভোজন করে আসছে, সে মৃতকে পিতৃলোকের নিকট প্রেরণ কর।... হে জাতবেদা! সে পুনর্বার শরীর লাভ করুক।” (১০ মণ্ডল : ১৬ সূক্ত : শ্লোক ৫ : ওই)

এই শ্লোকেও মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

(৮) বেদে স্বর্গ ।

বেদ-এর বেশ কিছু জায়গায় স্বর্গের বর্ণনা আছে।

অথর্ব বেদ ৪ অধ্যায় ৩৪ স্তোত্র : ৬ শ্লোক (দেবী চাদ)।

“সেখানে থাকবে মাখনের স্রোতধারা আর তার তীরভূমিতে থাকবে মধু। পরিশ্রুত জলধারা বয়ে যাবে, থাকবে দুধ ও দই এবং সবই তোমার জন্য আনন্দদায়ক হবে। এই সবগুলি অর্জন করে তুমি তাোমার আত্মাকে ভিন্ন ভিন্নভাবে শক্তিশালী করতে পারবে।”

অথর্ব বেদ ৪ অধ্যায় : ৩৪ স্তোত্র : শ্লোক ২

"পার্থিব শরীর থেকে মুক্ত হয়ে তারা যাবে বুদ্ধিদীপ্ত আলোর জগতে। অগ্নি তাদের পুঃ অঙ্গকে পোড়াতে পারবে না। আনন্দের জগতে তারা প্রচুর রমণী লাভ করবে।”

বেদে নরক।

বেদে যে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তা হল-'নরকাস্থানম'।

ঋগ্বেদে আছে : “বিদ্বান মিত্র ও বরুণের প্রিয় এবং ধ্রুব কর্মে যারা বাধা দেয়, সুন্দর ধনবিশিষ্ট ও তীক্ষ্ণদন্ত অগ্নি অত্যন্ত সন্তাপকর তেজ দ্বারা তাদের দগ্ধ করুন।” (৪ মণ্ডল : ৫ সূক্ত : ৪ শ্লোক)

ইসলাম ধর্মে মৃত্যুর পরের জীবন।

(১) পৃথিবীতে জীবন একবারই, পরকালে শুধু পুনরুত্থিত ইসলামধর্মে মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আছে। সূরা বাকারাহ-য় আছে :

“তোমরা কী করে আল্লাহকে অস্বীকার করো? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদের প্রাণ দিয়েছেন, আবার তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন এবং পুনরায় জীবন্ত করবেন, পরিণামে তোমাদের তার কাছেই ফিরতে হবে।” (২ নং সূরা : আয়াত ২৮)

ইসলাম বলে যে, মানুষ এই পৃথিবীতে একবারের জন্যই আসে এবং তারপরে মারা যায়। মৃত্যুকে ইসলামি পরিভাষায় বলে এন্তেকাল’ বা ‘স্থান পরিবর্তন। 

মহাবিচারের দিনে মানুষকে আবার পুনরুত্থিত করা হবে। সে যদি পৃথিবীতে ভালো কাজ করে তাহলে সে জান্নাতে যাবে, আর যদি খারাপ কাজ করে তাহলে জাহান্নামে বা দোজখে যাবে।

(২) এই জীবন পরকালের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ সূরা মুক’-এ আছে :

“যিনি মৃত্যু ও জীবন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টি করেছেন—কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।” (৬৭ নং সূরা : আয়াত ২) পৃথিবীতে আমরা যে জীবন যাপন করছি তা পরকালের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ।

যদি আমরা সর্বশক্তিমান স্রষ্টার আদেশ মেনে চলি তাহলে আমরা পরীক্ষায় উত্তাল হতে পারবো এবং প্রবেশ করতে পারবো অনন্ত সুখের আবাসস্থল জান্নাতে। 

যদি আমরা সর্বশক্তিমান স্রষ্টা মহান আল্লাহর আদেশ মেনে না চলি, তাহলে আমাদেরকে নরকে নিক্ষেপ করা হবে।

(৩) মহাবিচারের দিনে থাকবে পূর্ণ প্রতিদান ‘সূরা আল-ই-ইমরানে’ আছে :

“জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে (জীব মরণশীল)। কিয়ামতের দিন তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় দেওয়া হবে। যাকে আগুন (নরক) থেকে দূরে রাখা হবে এবং (যে) স্বগে প্রবেশ লাভ করবে সেই সফলকাম এবং পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগব্যতীত কিছুই নয়।” (৩ নং সূরা , আয়াত ১৮৫)

(৪) স্বর্গ : জান্নাত।

স্বর্গ বা জান্নাত চিরস্থায়ী অনন্ত সুখের জায়গা। আরবিতে ‘জান্নাত’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘বাগান। কোরআনে জান্নাতের পরিপূর্ণ বর্ণনা আছে। জান্নাতের তলদেশে নদী প্রবাহিত। এতে আছে সুস্বাদু দুধের নদী, পরিশ্রুত মধুর নদী। 

জান্নাতে সমস্ত শ্রেণির ফল আছে। জান্নাতে কোনও ক্লান্তি আসবে না। সেখানে কোনও পাপ, কোনও অসুবিধা, কোনও উদ্বেগ, কোনও সমস্যা, কোনও কষ্ট থাকবে না। জান্নাত হবে অফুরন্ত শান্তির চিরস্থায়ী আবাসস্থল।

কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বারে বারেই উঠে এসেছে জান্নাতের মনোলোভা জীবন্ত বর্ণনা।

“যারা সাবধান হয়ে চলে তাদের জন্য রয়েছে উদ্যানসমূহ, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে, তাদের জন্য পবিত্র সঙ্গিনী এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে। বস্তুত আল্লাহ তাঁর দাসদের দ্রষ্টা।”

“ওদেরই জন্য আছে স্থায়ী জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে ওদের স্বর্ণকঙ্কনে অলঙ্কৃত করা হবে, ওরা পরিধান করবে সুক্ষ্ম ও পুরু রেশমের সবুজ বস্ত্র ও সমাসীন হবে সুসজ্জিত আসনে, কত সুন্দর পুরস্কার আর কত সুন্দর আরামের স্থান!”

“সাবধানীদের যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তার দৃষ্টান্ত নিম্নরূপ : ওতে আছে নির্মল পানির নহর, আছে দুধের নহর যাব স্বাদ অপরিবর্তনীয়, আছে পানকারীদের জন্য সুস্বাদু সূরার নহর, আছে পরিশোধিত মধুর নহর এবং সেখানে ওদের জন্য থাকবে বিবিধ ফলমূল ও তাদের প্রতিপালকের ক্ষমা।”

(৫) নরক : জাহান্নাম।

যারা অবিশ্বাসী, যারা অসৎ কাজ করে চলে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের মর্মন্তুদ শাস্তি। সেখানে তারা ভয়ঙ্করতম কষ্ট ভোগ করবে। বস্তুত অবিশ্বাসীরা ও প্রস্তরখণ্ডসমূহ হবে জাহান্নামের জ্বালানি।

জাহান্নামিদের চামড়া প্রজ্জলিত হবে–তারপর আবার নতুন চামড়া তৈরি হবে—এইভাবে তারা লাভ করবে অতি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় জাহান্নামের বর্ণনা আছে।

(৬) ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির জন্ম-পার্থক্যের ব্যাখ্যা।

হিন্দুধর্মে বলা হয়, পূর্বজন্মের কর্মের জন্য পুনর্জন্মের সময়ে মানুষে মানুষে পার্থক্য রচিত হয়। এই পুনর্জন্মের অবশ্য কোনও বৈজ্ঞানিক বা যুক্তিগত প্রমাণ নেই। | ইসলামধর্ম মানুষে মানুষে পার্থক্যের এই ব্যাখ্যা মেনে নেয়নি।

সূরা মুল্ক’-এ আছে : “যিনি মৃত্যু ও জীবন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টি করেছেন—কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।” (৬৭ নং সূরা , আয়াত ২)

অর্থাৎ পার্থিব এই জীবন পরকালের জীবনের জন্য পরীক্ষাক্ষেত্র স্বরূপ। যিনি বিশ্বাসী এবং সৎকর্মপরায়ণ তিনি পরকালে জান্নাতে প্রবেশ করবেন, আর যিনি অবিশ্বাসী তার ঠিকানা জাহান্নাম। মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যই আল্লাহ মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন। পরীক্ষা করার জন্যই মানুষে মানুষে পার্থক্য রচনা করেছেন।

 ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের সাদৃশ্য - সূচিপত্র।